শংকর রায়, যাকে শংকর দা বলে ডাকতাম, তিনি চলে গেছেন। আর গেছেন এমন একখানে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায়না। বছর কয়েক আগেও যাই যাই করছিলেন; কিন্তু প্রিয়জনদের ভালবাসার টান ছিন্ন করতে ব্যর্থ হন। জগন্নাথপুরের তরুণ সাংবাদিক জুয়েল আহমদ জানালো, যে রাতে তিনি চিরবিদায় নেন সেই রাতেও সর্বশেষ খবরের সন্ধান করেছিলেন। লিখতে চেয়েছিলেন যখন গোটা দেশ সূর্যতাপের প্রখরতায় ঘরমুখো ঠিক তখনও নলুয়ার হাওরে খোলা আকাশের নিচে খরতাপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সোনার ফসল ঘরে তোলায় বিরামহীন কর্মব্যস্ত কৃষকের কথা। না, লেখা হয়নি বরং জীবনযুদ্ধে তাকে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে।
পরিচয় গত শতাব্দির আশির দশকের প্রথম দিকে যখন সাপ্তাহিক ‘দেশবার্তা’র টেবিলে ছিলাম। শংকর দা ছিলেন জগন্নাথপুর প্রতিনিধি। যাতায়াত খুব কষ্টকর ছিল, তবু মাঝে মধ্যে আসতেন। প্রতি সপ্তাতেই খবর পাঠাতেন একমাত্র মাধ্যম ডাকযোগে। তখনও কুরিয়ার সার্ভিস চালু হয়নি। টেলিফোন যোগাযোগ ছিলনা বললেই চলে।
শংকর রায় আসতেন। মোটাসোটা দেহখানি চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বসতেন অনেকক্ষণ। কথা বলতেন হাসিমাখা মুখে। ‘দেশবার্তা’র চা-টা ছিল সম্পাদক মহোদয়ের বাসায় তৈরি। তাই তৃপ্তি সহকারে খাওয়া যেতো। পাওয়াও যেতো ঘন ঘন। এ ক্ষেত্রে সম্পাদক হিমাংশু শেখর ধরের আন্তরিকতার পাশাপাশি মাসিমা আর দীপু দা-অপুদার তাগিদ লেগেই থাকতো।
‘দেশবার্তা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে শংকর দার সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসে। তবে গত কয়েক বছর ধরে আবার ঘন ঘন যোগাযোগ হচ্ছিল। সিলেট এলে দেখা করতেন। জগন্নাথপুর গেলেও দেখা হতো; কিন্তু আর হবে না।
যেমনি দেখা হবে না মোসাদ্দিক হোসেন সাজুলের সঙ্গে। এই শতাব্দির শুরুর দিকে তার সঙ্গে পরিচয়। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা। প্রায়ই রাত গভীরে ফোনে কথা হতো। সম্বোধন করতো ‘গুরু’ বলে। সাপ্তাহিক `বিশ্বনাথ বার্তা’র একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম সে কতটা গ্রহণযোগ্য। পরবর্তী সময়ে বিশ্বনাথ প্রেসক্লাবের (যা এখন বিশ্বনাথ মডেল প্রেসক্লাব) সভাপতি নির্বাচিত হলে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। সিলেট জেলা সদর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তাকে পাশে পেয়েছিলাম।
প্রিয় সাজুল অসুস্থ ছিল অনেকদিন ধরে। কথা হলে-দেখা হলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছে। কখনও খারাপ বলেনি। মুখে হাসি থাকতো। দেহমনে কঠিন লড়াই; কিন্তু মানসিক শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে, বুঝতে দিতো না। জানতো শেষ পরিণতি। তবু স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করে গেছে।
এমনই স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন বলে জানতাম স্নেহভাজন সাংবাদিক দেবাশীষ দেবুর মা-আমাদের মাসিমা সীমা রানী পাল।
হঠাৎ করেই জানা হলো, তিনি অসুস্থ। শেষপর্যন্ত তাকে যেতেই হলো ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে তার আর বাড়ি ফেরা হলোনা।
আমারও যায়নি তার বাড়িতে। তিনি সবজি বাগান করেছিলেন। আমি জানার পরপর ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম দেখার। একই সঙ্গে মাসিমার পায়ের ধুলো নেওয়ার; কিন্তু হলোনা। এ সময় দেবুর হঠাৎ করে জরুরি পারিবারিক প্রয়োজনে সিলেটের বাইরে চলে যাওয়া সহ নানা কারণে তাকে আর দেখা হলোনা। এ কারণে এক ধরনের যন্ত্রণা আমাকে দগ্ধ করছে।
Leave a Reply