পয়লা বৈশাখ আমাদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির শুভ নববর্ষ। এ দিনে আমরা বর্ষবরণ করে আসছি অনাদিকাল থেকে। তবে বর্ষবরণ আয়োজন গ্রাম আর শহরে একরকম নয়। শহরে একপর্যায়ে শুভ নববর্ষ বলতেই বুঝাতো পান্তা-ইলিশ আর জাঁকজমক অনুষ্ঠান। অবশ্য সরকারি নিষেধাজ্ঞায় পান্তা-ইলিশ এখন আর দেখা যায়না। অনুষ্ঠানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন তো সরকারি উদ্যোগেও নতুন বাংলা বছরকে বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করা হয়।
আমাদের শৈশবে বর্ষবরণ ছিল অন্যরকম। হাওর এলাকায় জন্ম নেওয়ার সুবাদে বৈশাখকে দেখেছি ভাটি এলাকার প্রধান সম্পদ বোরো ধান গোলায় তোলার উৎসবে, যা আজকাল দেখা যায়না। এখন অনেককিছু যান্ত্রিক হয়ে গেছে। তাই পাল্টে গেছে বৈশাখের রূপও। তবে শুভ নববর্ষে এখনও সেই সোনালী দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।
তখনকার সময়ে বসন্তে শুরু হতো বারুণী মেলা। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বনকে কেন্দ্র করে এসব মেলা বসতো। চলতো বৈশাখের শুরু পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালের পর অনেক ধনাঢ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী ভারতে চলে গেলে আস্তে আস্তে মেলার জৌলুসও কমতে শুরু করে। এছাড়া পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী বাঙালির এসব উৎসব আয়োজনকে ভাল চোখে দেখতোনা। তবু কিছু কিছু মেলাকে ঘিরে ভাটি এলাকার মানুষ উৎসবে মেতে উঠতেন। অপেক্ষায় থাকতেন। কোনো কোনো মেলায় সার্কাস ও যাত্রাপালা হতো।
অধিকাংশ মেলার নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। যেমন অমুক মাসের অমুক বার, তা সে যে তারিখই হোক। মেলার সময় যতই ঘনিয়ে আসতো আমাদের মধ্যে টাকা জোগাড় করার প্রতিযোগিতাও তত জোরালো হয়ে উঠতো-কে কত টাকা জোগাড় করে মেলায় যাবো। টাকার জন্য কত কান্নাকাটি। কত আব্দার মা-বাবার কাছে। তাও দুই-এক টাকা। আজকালের হিসাবে অংকটা একদম ফেলনা মনে হতে পারে; কিন্তু তখন দুই টাকা হলেই দুই হাত ভরে খেলনাপাতি কেনা যেতো। সঙ্গে মিষ্টি বা খই খাওয়াতো ছিলই।
গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী মেলা বলতে আলাদা কিছু ছিলনা। তবে অন্যরকম উৎসব ছিল। যেমন হালখাতা। মহাজনেরা অর্থাৎ ছোটবড়ো ব্যবসায়ীরা সারা বছরের বাকি উসুলের জন্য ক্রেতাদেরকে মিষ্টি খাওয়াতেন। এ জন্য আগে থেকেই চিঠি দিয়ে নিমন্ত্রণ জানানো হতো। ছাপা করা চিঠিও বাজারে কিনতে পাওয়া যেতো। তাতে কেবল তারিখ আর মহাজনের নাম লেখার জায়গা খালি থাকতো, যেখানে দোকানের মালিক নিজের নাম ও তারিখ বসিয়ে ক্রেতাদের বাসা-বাড়িতে পৌঁছাতেন। বৈশাখের কয়েকদিন ধরে চলতো এই উৎসব। প্রতিটি দোকানে লাল রঙের বিশেষ ধরনের হিসাবের নতুন খাতা খোলা হতো।
আমাদের এলাকার প্রধান সম্পদ বোরো ধান। পৌষ-মাঘের তীব্র শীতে হালিচারা উৎপাদন ও রোপণ শেষে চৈত্রের শেষদিকে শুরু হতো ধান কাটা। পুরো বৈশাখ মাস চলে যেতো সোনার ধান ঘরে তোলার কাজ। তখন বড়োদের যেন শ^াস ফেলার ফুরসৎ থাকতোনা। সেই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ আর কাজ। ছোটদেরও ব্যস্ততা কম থাকতো না।
ধান কাটার জন্য অন্যান্য জেলা থেকে নৌকা বোঝাই হয়ে লোক আসতো। আমাদের এলাকায় তাদেরকে বলা হতো ‘দাওয়াইল্লা’ বা ‘নাইয়া’। তাদের যিনি প্রধান থাকতেন তাকে বলা হতো ‘বেপারী’। বোরো মৌসুমের শুরুতেই তিনি এসে গৃহস্থদের সঙ্গে চুক্তি করে যেতেন। তাও মৌখিক। কারণ পারস্পরিক বিশ^াস ছিল। মজুরি হিসাবে তারা নতুন ধান নিয়ে ফিরে যেতেন।
ধান কাটার পর প্রতিটি হাওরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় মাড়াই দেওয়া হতো। আমরা বলতাম ‘মাড়া দেওয়া’। এখনকার মতো তখন মাড়াইকল ছিলনা। গরু দিয়ে মাড়াই দেওয়া হতো। বাঁশের তৈরি এক ধরনের ছাটাই বিছিয়ে তার উপর ধান মাড়াই দেওয়া হতো গ্রীষ্মের প্রচÐ গরমের মধ্যে। এই ছাটাইকে বলা হতো ‘ডাম’। আগেই বাজার থেকে কিনে আনা হতো। এরপর বাড়ির নারীরা গোবর দিয়ে ‘ডাম’ লেপে রোদে শুকিয়ে নিতেন। এছাড়া ধান শুকানোর কাজেও এই ‘ডাম’ ব্যবহার হতো। তবে বেশি ধান যাদের ছিল তারা ‘খলা’য় অর্থাৎ বাড়ির কাছে আগে থেকেই প্রস্তুত করা নির্দিষ্ট জায়গায় ধান শুকাতেন।
বড় গৃহস্থরা মাড়াই করা ধান গরুর গাড়িতে করে ‘খলা’য় নিয়ে আসতেন। নারীরা সেই ধান শুকানোর দায়িত্ব পালন করতেন। সেকি কষ্ট; কিন্তু কষ্টকে পাত্তা না দিয়ে তারা পরম আনন্দে এ দায়িত্ব পালন করতেন। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে সেই ধান বাড়িতে নিয়ে আসা হতো বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাই মিলে। পরদিন সকালে আবার ‘খলা’য় নিয়ে মেলে দেওয়া হতো। এভাবে কয়েকদিন চলতো।
এ সময় সহমর্মিতার একটি চমৎকার নজির দেখা যেতো। মাঝে মধ্যে ঝড়-বৃষ্টি হানা দিতো। তখন আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে ‘খলা’ থেকে ধান নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে সহযোগিতা করতেন। কার ধান-সেই প্র্শ্ন কারও মাথায় আসতোনা। ধান রক্ষাই থাকতো লক্ষ্য।
ক্ষুদ্র গৃহস্থরা হাওরে মাড়াই করা ধান বাড়িতে আনতে ব্যবহার করতেন তিনটি বাঁশ দিয়ে তৈরি চাকাবিহীন এক প্রকারের পরিবহন দিয়ে। নাম ছিল ‘ফল্লা’। এক-দুই বস্তার বেশি ধান তাতে করে আনা যেতোনা। কেউ কেউ কাঁধে বা মাথায় করেও ধান নিয়ে আসতেন।
গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ে ছোটদের খুব কদর ছিল। গরুকে পিছন থেকে খেদানোর কাজে তাদের উৎসাহ থাকতো খুব। এই সুযোগটা নিতেন বড়রা। ছোটদেরকে গরু খেদানোর কাজে লাগিয়ে নিজেরা কখনও বিশ্রাম নিতেন-কখনও অন্য কাজ সেরে নিতেন। ‘খলা’য় কাক-পক্ষী খেদানোর কাজেও ছোটদেরকে খুব ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হতো।
ছোটরাও সুযোগ নিতে ছাড়তোনা। তখন ফেরিওয়ালা আসতো খুব বেশি। ‘দাওয়াইল্লা’র মধ্যে কেউ কেউ ফেরি করতো। তারা মূলত মিষ্টি আলু বিক্রি করতো। অন্যান্য মৌসুমী ফেরিওয়ালা আসতো মিষ্টি জাতীয় নানা জিনিস নিয়ে। এর মধ্যে চিনির তৈরি ছোট ছোট রঙিন গøাস, লাঠি ও ঘি চমচম (ঘি তাতে আদৌ থাকতো কি না এখন সন্দেহ হয়) ছিল বেশি আকর্ষণীয়। তাই ছোটরা বায়না ধরতো। তখন তাদেরকে কাজে লাগানোর স্বার্থে তাদের বায়না মেটানো হতো। কাপড় নিয়ে ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি ঘুরতো। আসতো চুড়িওয়ালিরা। আসবাবপত্র নিয়েও কেউ কেউ আসতো।
মিষ্টি আলু আসতো নৌকা বোঝাই করে বিভিন্ন জেলা থেকে। ফেরিওয়ালারা ‘মদন’ ‘মদন’ বলে হাঁকাহাঁকি করতো। ঐসব জেলায় মিষ্টি আলুকে ‘মদন’ বলে। তাই তারা ‘মদন’ ‘মদন’ আওয়াজ তুলতো। এমনিতেই কামড়ে কামড়ে, সিদ্ধ দিয়ে, মাটির চুলোর পুড়িয়ে, পাতলা করে কেটে কেটে, রেঁধে-নানাভাবে মিষ্টি আলু খাওয়া যেতো।
আমাদের বেপারীর নাম ছিল লাল মিয়া। তাই তিনি ‘লাল বেপারী’ নামেই পরিচিতি পান। বাড়ির পাশে নদী। আমাদের ঘাটেই বাঁধা থাকতো তার নৌকা। তাই মাঝে মাঝে যেতাম। মূল উদ্দেশ্য থাকতো মিষ্টি আলু। ধান কাটার কাজে ব্যস্ত নিজের দলের লোকজনের জন্য তিনি দুপুরে সিদ্ধ করা মিষ্টি আলু নিয়ে যাওয়ার সময় দুয়েকটি আমার হাতে তুলে দিতেন। কখনও কখনও কাঁচাও দিতেন।
তাকে ‘বেপারী চাচা’ বলে ডাকতাম। খুব আদর করতে আমাকে। আমাদের পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক এত গভীর হয়ে গিয়েছিল যে, ধান কাটার মৌসুম ছাড়াও বছরে একবার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। থাকতেন ৪-৫ দিন। একবার আমার বাবাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ওখানে; কিন্তু ফেরৎ পাঠানোর নাম নেই। প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। তখনতো চাইলেই যোগাযোগ করা যেতোনা। যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টকর। টেলিফোনে যোগাযোগ করার উপায় নেই। এদিকে বাড়ির সবাই খুবই উদ্বিগ্ন। দাদিতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। বড় চাচাকে বকাঝকা করছেন কেন বাবাকে যেতে দিলেন। বড় চাচাও উদ্বিগ্ন। তবু আরও দু-তিনটি দিন অপেক্ষা করার জন্যে অনুরোধ করতে থাকলেন।
যখন কোন শান্তনাই আমাদের উৎকণ্ঠা দূর করতে পারছিলনা তখন-ঠিক ১০ দিনের মাথায় বাবা বাড়িতে এসে হাজির। মুখে তৃপ্তির হাসি। সবাই যখন রীতিমতো তাকে দোষারূপ শুরু করলেন বাড়িসুদ্ধ লোককে উৎকণ্ঠায় রাখার জন্যে তখন তিনি গল্প শুরু করলেন, কিভাবে বেপারী চাচারা তাকে আদর-যতœ করেছেন, বাড়ি বাড়ি দাওয়াত খাইয়েছেন. দল বেঁধে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
সেইদিন আর নেই। আমরাইতো সেইসব সোনালী দিনের কথা ভুলে যাচ্ছি। আর নতুন প্রজন্মতো জানেইনা। তাদেরকে দোষ দিচ্ছিনা। ব্যর্থতা আমাদের। আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল-স্বর্ণোজ্জ্বল সময়টাকে তাদের সামনে সঠিকভাবে তুলে ধরছিনা।
লেখক : সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার সিলেট।