দি সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ গত ৪ জুন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী, এনডিসির সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়ে সিলেটের ভয়াবহ আকস্মিক বন্যা নিরসনকল্পে কিছু প্রস্তাবনা হস্তান্তর করেন।
এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, হজরত শাহজালাল (র) ও হজরত শাহপরান (র) সহ ৩৬০ আউলিয়া এবং শ্রীচৈতন্য দেবের পুণ্যভূমি সিলেট অঞ্চল গত ২০ বছরে ছোট-বড় ৯টি বন্যার মুখোমুখি হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি মানুষ। সিলেট মূলত কৃষি, মৎস্য এবং পর্যটন ও বিদেশী রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। এ সকল সম্পদের সবই বিলীন হয় বন্যার আগ্রাসনে। বন্যার কারণে যে পরিমাণ ক্ষতি প্রতিনিয়ত হচ্ছে তাতে পুরো অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে মারাত্মক ধাক্কা লাগছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮ সালের পরবর্তী বন্যা ছিলো ২০০৪ সালে। এরপর ধারাবাহিকভাবে এই ২০ বছরের মধ্যে ২০১০, ২০১৭, ২০২০, ২০২২ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের বন্যাসহ ছোটবড় ৯টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয়েছে শান্তিপ্রিয় সিলেটকে। এভাবে সামাজিক সূচকের সকল কাঠামোকে প্রতিনিয়তই ক্ষতবিক্ষত করছে এই বন্যা। ভবিষ্যতে এর মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে আসছে।
প্রথমত বন্যার কারণ যা তা হচ্ছে বৃহত্তর সিলেটের নদ-নদীর বেহাল দশা। দখলে দূষণে জর্জরিত সকল নদ-নদী। অপরিকল্পিত আবাসন, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে অবৈধ দখলে নদী ভরাট এবং অপরিকল্পিত ড্রেজিং সহ আবর্জনা ভাগাড়ের কারণেই এমন দশা। এছাড়া হাওরের খাল-নালা ভরাট এবং পুকুর-জলাশয়ের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করায় সিলেট এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বছর ৪ আগে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা, হবিগঞ্জের খোয়াই ও বিবিয়ানা এবং সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীর অবৈধ দখলদারদের নাম তালিকা প্রকাশ করলেও এসকল অবৈধ দখলদারের বিপক্ষে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে আরও দখল হওয়ায় নদীর আসল রূপ হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখনও কোনও কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে সিলেটে নদী বলতে কিছুই থাকবে না। ফলে সিলেটের মানুষকে আরও কঠিন বিপদের সম্মুখিন হতে হবে ।
বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে শুধুমাত্র সিলেট জেলায়ই সুরমা, কুশিয়ারা, ডাউকি, পিয়াইন, ধলাই, লোভা, সারি, বাসিয়া ও চেঙ্গেরখাল গতিপথ হারিয়ে ফেলেছে। বিশেষ করে ডাউকি, পিয়াইন, ধলাই, লোভা ও সারি নদীর বালি ও পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় সীমান্ত এলাকার সব উপজেলা ক্ষত-বিক্ষত। ভারত থেকে আসা পাথর ও নুরি পাথরের স্তুপ জমা হওয়া পানির প্রবাহে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করায় এরকম বিপর্যয় চলমান রয়েছে। অথচ আগে কখনওই এরকম আকস্মিক বন্যা সিলেটে পরিলক্ষিত হয়নি। এ জন্য পাথর ও বালি উত্তোলন প্রক্রিয়া যৌক্তিক ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে করা হলে কিছুটা হলেও বন্যা থেকে এ অঞ্চল রক্ষা পাবে।
এছাড়া সুনামগঞ্জের ধোপাজান, যাদুকাটা, নলজুর, বৌলাই, রক্তি, চেলা, খাসিয়ামারা, কুশিউরা, মাহরাম, মহাসিং ও বোকা নদী, মৌলভীবাজারের ধলাই, মনু, জুড়ী, কণ্টিনালা ও গোপলা নদী আর হবিগঞ্জের খোয়াই, সুতাং, সোনাই, বরাক, কাষ্টি ও করাঙ্গী নদীকে জরুরি ভিত্তিতে পুন:বিবেচনায় ড্রেজিং, দখলদারিত্ব দূরীকরণ ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ গবেষণাভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ পূর্বক এর সাময়িক সমাধান করতে পারলে কিছুটা হলেও বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এসব নদী নিজের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলায় মূলত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, এ অঞ্চলের মাটির গুণগত মানের পরিবর্তন, কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি, মৎস্য সম্পদের ক্ষতি এবং জনস্বাস্থ্যের সীমাহীন ক্ষতি করছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে পুরো অঞ্চলের সামাজিক সুরক্ষা ভেঙে পড়ছে। এর থেকে উত্তরণে একমাত্র উপায় হিসেবে সাময়িক চিন্তাভাবনা না করে দীর্ঘ মেয়াদী অথবা স্থায়ী কার্যকরী পরিকল্পনা সমন্বিতভাবে গ্রহণ করতে হবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য সংশ্লিষ্টদের যেমন পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি ও মৎস্য অধিদপ্তর, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও প্রকৌশল বিভাগের গবেষক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, নদী রক্ষা কমিশন, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, সিলেট সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় প্রশাসন, দি সিলেট চেম্বার অব কমাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ সহ অন্যান্য সরকারি বেসরকারি (যারা এর সাথে সম্পৃক্ত) দপ্তরের কর্মকর্তা ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গকে একত্রিত করে গবেষণাভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রস্তাবনায় সিলেট চেম্বারের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়।
আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে বিস্তর আলোচনা সাপেক্ষে একটি উদ্যোগ বা প্রস্তাবনা নেওয়া যেতে পারে, যা হবে সিলেট অঞ্চলের জন্য মঙ্গলজনক।
একইসঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে সিলেটের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার জন্য সিলেট চেম্বারের পক্ষ হতে দাবি জানানো হয়েছে।
ছবি : এম এ মতিন, গোয়াইনঘাট
Leave a Reply